প্রীতমকে জেলে পাঠানো ছাত্রলীগের অবমাননা: মুনতাসীর মামুন

Staff Staff

Reporter

প্রকাশিত: ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২২

পাকিস্তানের দুর্দশা নিয়ে দেশটির লেখক সাদত হাসান মান্টোর একটি উক্তি ফেসবুকে পোস্ট করে ‘ধর্ম অবমাননা’র মামলায় জেলে আছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রীতম দাশ।

প্রীতমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী মাহবুব আলম ভুঁইয়া। সে মামলায় শুক্রবার সন্ধ্যায় শ্রীমঙ্গল শহরের একটি বাড়ি থেকে প্রীতমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

মান্টোর যে উক্তিটি প্রায় দুই মাস আগে প্রীতম ফেসবুকে পোস্ট করেন,সেটি তিনি নিয়েছিলেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের একটি নিবন্ধ থেকে। একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে ‘নও পাকিস্তানি নও বাংলাদেশ’ শিরোনামের ওই নিবন্ধটি ৭ জুলাই প্রকাশিত হয়।

পাকিস্তানের দুর্দশার বর্ণনা করতে গিয়ে মান্টোর ওই উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন মুনতাসীর মামুন, যা পরের দিন (৮ জুলাই) ফেসবুকে পোস্ট করেন প্রীতম।

এ ঘটনায় প্রীতম দাশের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকর্মীর মামলা করায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।

বর্তমানে দেশের বাইরে থাকা এই অধ্যাপক মোবাইলফোনে বলেন, ‘ছাত্রলীগের পরিচয়ে যারা এ কাজ করেছে তারা ছাত্রলীগকে অবমাননা করেছে। তারা ছাত্রলীগকে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। এটা তো হতে পারে না। এরা এ কাজ করে আওয়ামী লীগের আদর্শকেও অবমাননা করেছে।’

প্রীতমের বিরুদ্ধে এ অভিযোগে মামলা নেয়ায় পুলিশেরও সমালোচনা করেন মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ আচরণ বিভিন্ন জায়গায় এসব ক্ষেত্রে আমরা যা দেখছি তা পুলিশের পক্ষে যায় না। ফেসবুকের স্ট্যাটাস নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় এমন কিছু বিতর্কিত ঘটনা ঘটছে, যা আমরা সমর্থন করি না।

‘আমি মনে করি, পুলিশ কথায় কথায় এমন গ্রেপ্তার যেন না করে। এটা আমাদের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে, সংবিধানের বিরুদ্ধে যায়।‘

নিজের লেখার একটি অংশ পোস্ট করে প্রীতম ‘ধর্ম অবমাননা’ মামলার আসামি হয়েছেন- এমন বিষয়টি নিয়ে ব্যথিত মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে লিখছি। আমার বিরোধীরাও আমার লেখায় অবমাননা পায়নি। এখন নব্য কিছু ছেলে যদি ধর্ম অবমাননা পায় সেখানে আমার কিছু বলার নেই। এভাবে চললে তো এরা বাংলাদেশে সব কথাতেই অবমাননা খুঁজে পাবে।’

 

যা ঘটেছিল

পাকিস্তানের জনপ্রিয় লেখক মান্টোর একটি উক্তি গত ৮ জুলাই ফেসবুকে পোস্ট করেন প্রীতম। এর ঠিক আগের দিন ৭ জুলাই একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ‘নও পাকিস্তানি নও বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি লেখায় পাকিস্তানের দুর্দশার বর্ণনা করতে গিয়ে মান্টোর ওই উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন।

সেই লেখা থেকে নেয়া মান্টোর উদ্ধৃতি নিয়ে পোস্ট দেয়ার পর প্রীতমের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম অবমাননার’ অভিযোগ তোলেন শ্রীমঙ্গল পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেন। তাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। সেই পোস্ট ভাইরাল হলে শ্রীমঙ্গলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

গত ৩১ আগস্ট প্রীতম দাশকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে উপজেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল করে ‘শ্রীমঙ্গলের ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতা’। এর পর থেকে প্রীতম আত্মগোপনে ছিলেন।

মান্টোর উদ্ধৃতি নিয়ে গত ২৮ জুলাই সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ছেলে এবং মৌলভীবাজার-২ আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম নাসের রহমান নামের ফেসবুক পেজ থেকেও একই স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছিল। তবে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে কেবল প্রীতমের বিরুদ্ধে।

চা শ্রমিকদের সাম্প্রতিক আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার কারণে তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো হয়েছে বলে এর আগে নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন প্রীতম।

 

কী আছে আবেদ হোসেনের স্ট্যাটাসে

শ্রীমঙ্গল পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেন গত ২৯ আগস্ট নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট দেন।

গত ৮ জুলাই দেয়া প্রীতমের পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করে এতে আবেদ লেখেন (বাক্য, বানান অপরিবর্তিত), ‘আমি তার ফেসবুকে ৭ জুলাইয়ের একটি পোস্টের স্ক্রিনশট দিলাম যেখানে সে দেশের অবস্থা নাজেহাল বুঝাতে গিয়ে আমাদের ইসলাম ধর্মকে ব্যাঙ্গ করে উদাহরণ দিয়েছে, জুমার নামাজ, মুসজিদের ইমাম এবং মুসল্লীদের নামাজ পরাকে ব্যাঙ্গ করেছে।’

স্ট্যাটাসে আবেদ লেখেন, ‘আমি শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসন ও শ্রীমঙ্গল থানার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই এ ধরণের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে যারা পবিত্র ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক কথা বলে তাদেরকে অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় এনে তারা কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে করতে চায় তা বের করা দরকার।‘

আবেদের এই স্ট্যাটাসের পর তার অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মীসহ আরও অনেকে বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এর পরের বুধবার মিছিল হয় শ্রীমঙ্গলে। সেই মিছিল থেকে প্রীতমকে গ্রেপ্তারে শুক্রবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়।

 

চা শ্রমিক আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন প্রীতম

চা শ্রমিকদের সাম্প্রতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকায় প্রীতমের পুরোনো একটি স্ট্যাটাস নিয়ে শ্রীমঙ্গলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উসকানি ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে।

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ২৭ আগস্ট শ্রীমঙ্গলে সমাবেশ করে ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন। শ্রীমঙ্গলে চৌমোহনা চত্বরে আয়োজিত এ সমাবেশে হামলার ঘটনা ঘটে। আয়োজকরা প্রথম থেকেই অভিযোগ করছেন, স্থানীয় ছাত্রলীগের একটি অংশ এ হামলা চালায়।

প্রীতম দাশ ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। হামলার পর ২৯ ও ৩০ আগস্ট শ্রীমঙ্গলে দুটি সংবাদ সম্মেলন করে ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’। সেখানে লিখিত বক্তব্য পড়েন প্রীতম দাশ।

এতে তিনি অভিযোগ করেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেনের নেতৃত্বে তার অনুসারীরা সমাবেশে হামলা চালায়। এতে প্রায় ১০ জন কর্মী আহত হন।

এই সংবাদ সম্মেলনের পর পরই ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে প্রীতমের বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেন আবেদসহ অন্যরা।

প্রীতম দাশ গত ৩১ আগস্ট বলেন, ‘চা শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আমাদের সমাবেশে আবেদের নেতৃত্বে হামলা করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আমি তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছিলাম। সে কারণে সে ক্ষুব্ধ হয়ে আমার নামে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে উসকানি ছড়াচ্ছে।’

 

আবেদ হোসেনকে ‘সতর্ক করেছে’ ছাত্রলীগ

প্রীতম দাশের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা শ্রীমঙ্গল পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবেদ হোসেন সতর্ক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য।

তিনি মঙ্গলবার বলেন, ‘আর যাতে এমন ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক ছাত্রলীগ। নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অতি উৎসাহে কেউ যাতে মামলা না করে বা ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত দিয়ে বক্তব্য না দেয় সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।’

প্রীতমের বিরুদ্ধে মামলাকারী মাহবুব আলম ভুঁইয়া ছাত্রলীগের ‘কেউ নন’ বলেও দিবি করেন তিনি। লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘ঘটনাটি নজরে এলে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ। আবেদকে সতর্ক করা হয়েছে। আর মাহবুব ছাত্রলীগের কেউ নন। তাকে আবেদ ছাড়া ছাত্রলীগের অন্যরা চেনেন না। তাই আবেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব।’