বিজয়ের ৫০ বছর: কোন পথে ছাত্র রাজনীতি

Staff Staff

Reporter

প্রকাশিত: ১২:১৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৬, ২০২১

বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবজনক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যে নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, সেই সময় থেকেই শুরু হয়েছে ছাত্র রাজনীতির পচন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্ররা। এই আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে এমনই এক ঘটনা, দাবি পূরণের পরেও যার রেশ থেকে যায়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ।

১৯৬৯ সালে সব ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণা পুষ্ট ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করে। এর ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য করা হয়। এরপর এক জনসমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’উপাধি দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ছাত্রলীগের সাত নেতা খুন হন। ওই সময়কার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান এই খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শফিউলের মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও ৭৫-এর পর জিয়াউর রহমান তাকে বিএনপিতে যোগদানের শর্তে ক্ষমা করে দিয়ে মুক্তি দেন।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর ক্যাম্পাসগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়তে থাকে। ক্ষমতা ধরে রাখতে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন স্বৈরশাসক এরশাদও। এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি যখন যে দলটি ক্ষমতায় আসছে তখনই ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়।

ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরা রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরের পর বছর রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল। ধর্মকে হাতিয়ার করে রাজনীতি করা এই সংগঠনটির নেতারা প্রতিপক্ষের কর্মীদের হাত-পায়ের রগ কেটে দিত, এজন্য এটিকে রগকাটা সংগঠন হিসেবে অনেকেই মনে করতো৷

বিএনপির শাসনামলে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বার বার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়ায় ছাত্রদলের নেতারা। ভ্রাতৃপ্রতীম ছাত্র শিবিরের সঙ্গেও তাদের সংঘাত-সংঘর্ষ ছিল নিয়মিত ঘটনা। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রদল টেন্ডারবাজি, ছাত্রী নিপীড়নসহ হাজারো অভিযোগে বিদ্ধ ছিল প্রায় সময়ই। অছাত্রদের এই সংগঠনের নেতৃত্বে রাখা এক সময় অঘোষিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল।

টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এই সময়ে ছাত্রলীগ সারাদেশে তাদের আধিপত্য পুরো প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় নিজেদের মধ্যে বার বার সংঘাতে জড়িয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। সাধারণ ছাত্ররাও এদের হাতে বলি হয়েছেন অনেকবার। সংগঠনটির নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নানা সময়ে শিরোনাম হয়েছে৷ এ বছর চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷

স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে ঢাবিতে ৭৪, রাবিতে ২৯, চবিতে ১৯, জাবিতে সাত, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। নিজ সংগঠনের নেতাকর্মী বা প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে এসব খুনের ঘটনা ঘটছে।

এরশাদের শাসনামলের পর ২৮ বছর আটকে ছিল ডাকসু নির্বাচন। বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে ২০১৮ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও তা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তাই ডাকসুর পর অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের যে আশা জেগেছিল; তা পূরণ হয়নি।

গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় পা রাখার পর থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে গেছে এককেন্দ্রিক। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, ক্যাম্পাসে শুধু তাদের তৎপরতাই থাকে। বাকিরা রীতিমত নিষিদ্ধ। তবে এটা জনপ্রিয়তায় বা ভালোবাসায় নয়; গায়ের জোরে ভয় দেখিয়ে। সমস্যাটা এখানেই। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন বর্তমান ছাত্রলীগ এখন মাস্তানি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি নিয়েই ব্যস্ত।

তবে আগে যেসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নেই, সেখানেই জঙ্গিবাদের চাষবাস হয়েছে। অনেকেই বলেন, এখন আর ছাত্র রাজনীতির কোনো লক্ষ্য নেই, তাই এর দরকারও নেই। কিন্তু ছাত্রদের লক্ষ্য পূরণে এখনও অনেক দাবি রয়েছে। শিক্ষার দাবি, স্বৈরাচার পতনের দাবি, সমাজ বদলের দাবি- এমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নেই তাদের সামনে। এখনও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা সমস্যা আছে। সেই সব সমস্যা সমাধানে ছাত্র নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

এছাড়া গণতন্ত্রের দাবি, ভোটাধিকারের দাবি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবি আদায়েও ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে বর্তমানে ছাত্র সংগঠনগুলো দানবে পরিণত হয়েছে। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর এখন জানা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টর্চার সেল আছে।

ছাত্রলীগের মত ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের নামে এখন গুগলে সার্চ দিলে হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির নিউজগুলোই আসে। প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্র সংগঠনগুলো এতো বিপথগামী হলো কিভাবে? তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার কি কেউ নেই? দেশের বিভিন্ন স্থানে মূল দলের নেতারাই ছাত্রলীগকে তাদের অপকর্মের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে। আর দোষ হয় ছাত্রলীগের একার। কারা ছাত্রলীগকে দানব বানালো, সেটাও দেখা দরকার।

বুয়েটের যে ছাত্ররা সহপাঠী আবরারকে পিটিয়ে মারলো, তারা সবাই কিন্তু এলাকায় নম্র, ভদ্র হিসেবে পরিচিত। সেই মেধাবী ছাত্রগুলো কিভাবে বুয়েটে এসে এমন খুনি হয়ে গেল? বুয়েট কর্তৃপক্ষ কি একবারও ভেবে দেখেছেন? মানলাম ছাত্রলীগ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। কিন্তু তাহলে প্রভোস্ট, প্রক্টর, ভিসিরা কী করেন? তারা কেন আটকান না ছাত্রলীগকে?  এর কারণ সেই শিক্ষকরাও দলীয় রাজনীতির বিষে নীল।

আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে সমগ্র বাঙালি জাতিকে যিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা কখনও ভাবেননি; ছাত্রজীবন থেকে যিনি নিজের জীবনকে সাধারণ মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ এ রকম বহু ত্যাগী রাজনীতিবিদ-ছাত্রনেতা রয়েছেন, যারা তাদের আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের কথা কখনও ভাবেননি।

কিন্তু এখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে হানাহানির রাজনীতি। দলীয় রাজনীতি ছাত্রদের বিপথে পরিচালিত করছে। ক্ষমতা, অর্থ আর অস্ত্র পেশিশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না হতেই কে কোন দল করে, বড় ভাইয়েরা নিজেদের দল ভারি করার জন্য ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব খাটিয়ে নিজের দলে ভিড়িয়ে মিটিং-মিছিলে অংশ নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, নির্যাতন করে, সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলে স্বার্থসিদ্ধির জন্য যা যা করার সবই করছে। এসব অন্যায়-অনাচার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জেনে-শুনেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে; যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

অভিভাবকদের অনেকেই নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে হলেও সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠান। কিন্তু সেই সন্তান কখনও অন্যকে খুন করে নিজে জেলে যাচ্ছেন কিংবা অন্যের হাতে খুন হয়ে দুঃখী বাবা ঘরে আলো নিভিয়ে দিচ্ছেন।

শিক্ষা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে, নীতি-নৈতিকতা জীবনকে সুস্থ, সুন্দর আর সমৃদ্ধ করে তোলে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। শিক্ষকরা চেষ্টা করছেন কত কম সময় দিয়ে কত বেশি অর্থ উপার্জন করা যায়।