২০২৫ বছরটি শেষ হচ্ছেনি শুধু সময়ের মতো; এটি ইতিহাসেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে নানা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের প্রয়াণের জন্য। এই বছর বিশ্ব শিল্প, রাজনীতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সিনেমা, সংগীত, ক্রীড়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যाग করতে হয়েছে। তারা তাদের দৃষ্টান্তমূলক অবদান দিয়ে মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।

ধর্ম ক্ষেত্রে, ৮৮ বছর বয়সে ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পোপ ফ্রান্সিস প্রয়াত হয়েছেন। তিনি জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় ক্যাথলিক চার্চের নেতৃত্ব দিয়ে ধর্মের আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার অবদানগুলোতে চ্যাম্পিয়ন করেছেন নারীদের নেতৃত্বে সুযোগ, সমকামিতার বিষয়ে ক্যাথলিক অবস্থান কিছুটা নমনীয় করেছেন এবং ভ্যাটিকানে সাধারণ মানুষের কাছেও তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এপ্রিলে তার শেষকৃত্যে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ অংশ নেন।

ফেব্রুয়ারিতে মারা যান ইসমাইলি মুসলিমদের আধ্যাত্মিক নেতা আগা খান করিম আল হুসেইনি, যিনি দেড় কোটি ইসমাইলির ধর্মীয় নেতার পাশাপাশি একজন জনপ্রিয় ও সমृद्ध ব্যক্তি ছিলেন।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এই বছর ছিল শোকের বছর। বাংলাদেশের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত গণঅভ্যুত্থানের সাহসী নেতা শরিফ ওসমান হাদি মাত্র ৩৩ বছর বয়সে চলে গেছেন। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়, যখন তিনি একটি অটোরিকশায় চেপে গাড়ি যাচ্ছিলেন। তাকে গুলি করে হত্যার ঘটনাটি বিশ্বমিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, এবং জাতিসংঘ এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি, যিনি ৮৪ বছর বয়সে মারা যান, এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ফ্রান্সের কট্টর ডানপন্থি নেতা জ্যঁ-মারি ল্য পেনও এ বছর মারা যান। এই স্বজনের তালিকায় নাইজেরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারি, উরুগুয়ে বিশিষ্ট প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা, এবং জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তোয়ামিচি মুরায়ামাসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন।

বিজ্ঞান জগতেও এই বছর বিষাদের ছায়া পড়ে গেছে। পরিবেশ সচেতনতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা প্রাইমেট গবেষক জেন গুডল, অ্যাপোলো-১৩ এর কমান্ডার জিম লাভেল, এবং ডিএনএ গঠনে অবদান রাখা জীববিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন—তাদের সবাই এই বছর মৃত্যুবরণ করেছেন, বয়স হয়েছিল যথাক্রমে ৯১, ৯৭ ও ৯৭ বছর।

চলচ্চিত্র ও বিনোদন জগতেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। হলিউডের কিংবদন্তি অভিনেতা রবার্ট রেডফোর্ড, যিনি ‘দ্য স্টিং’, ‘আউট অফ আফ্রিকা’ ও ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’ ফুটিয়ে তুলেছিলেন, সেপ্টেম্বরে মারা যান। এছাড়া অভিনেত্রী ডায়ান কিটন এবং রহস্যময় চলচ্চিত্র নির্মাতা ডেভিড লিঞ্চ এর মৃত্যু বিশ্বজুড়ে শোকের সৃষ্টি করে। অভিনেতা ভ্যাল কিলমার, যিনি নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তার মৃত্যু হয় নিউমোনিয়ায়।

ক্রীড়ার দিক থেকে অসংখ্য কিংবদন্তি বিদায় নিয়েছেন। হেভিওয়েট বক্সার জর্জ ফোরম্যান, কুস্তির আইকন হাল্ক হোগান, ও লিভারপুলের পর্তুগিজ ফুটবলার দিওগো জোটা—তাদের আর দেখা যাবে না এই পৃথিবীতে। ক্রীড়াজগতে এই বছর হারানোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা।

সাহিত্য ক্ষেত্রে এই বছর অজস্র প্রভাবশালী লেখক ও নাট্যকারের মৃত্যু হয়েছে। নোবেলজয়ী পেরুভিয়ান লেখক মারিও ভার্গাস ইয়োসা, নাট্যকার টম স্টপার্ড, ও কেনিয়ান লেখক নগুগি ওয়া থিয়ং’ও—সবারই মৃত্যু হয়েছে এই বছর।

সংগীত দুনিয়ায়, হেভি মেটাল তারকা অজি অসবোর্নের মৃত্যুর খবর শোনা গেছে। বিচ বয়েজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান উইলসনও চলে গেছেন। এছাড়াও স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী রোবার্টা ফ্ল্যাক, জিমি ক্লিফ, ম্যারিয়েন ফেইথফুল ও স্লাই স্টোনের মতো ওপার থাকা তারকারা স্মৃতি হয়ে থাকছেন নিজেদের জনপ্রিয়তা ও কর্মজীবনের জন্য।

সাংবাদিকতা ও আলোকচিত্রে এই বছর শোকের ছায়া। গাজা পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি হামলায় রয়টার্সের ক্যামেরাপারসন হুসাম আল-মাসরিসহ পাঁচজন নিহত হয়েছিলেন। বিখ্যাত আলোকচিত্রী সেবাস্তিয়াও সালগাদো, যিনি তার জীবনাবসান ঘটিয়েছেন এই বছর, তাঁর কাজের জন্য বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি পেয়েছেন।

অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা—বিখ্যাত স্থপতি ফ্র্যাঙ্ক গেহরি, ব্রিটেনের প্রথম নারী গোয়েন্দা প্রধান স্টেলা রিমিংটন, স্পেস স্কাইডাইভার ফেলিক্স বাউমগার্টনার, ব্যবসায়ী ফ্রেডেরিক স্মিথ—তাদের সবাই এ বছর অচিরেই এই পৃথিবী ছাড়বেন।

সর্বমোট, ২০২৫ সালের এই এক বছর ছিল মৃত্যুর মাঝে এক অভূতপূর্ব প্রতিফলন—প্রভাবশালী ব্যক্তি, তাদের কাজ ও অবদানসহ অনেক স্মৃতি হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে দীর্ঘ দিন। এটি শুধু সময়ের হিসাব নয়, বরং ইতিহাসের পাতায়ও স্থান করে নেবে অসংখ্য মানুষকে বিদায় দেওয়ার জন্য।