নাটোরের ১৫টি গ্রামে দেড়শে বেশি ভেষজ প্রজাতির সমৃদ্ধ ঔষধি গ্রাম

Staff Staff

Reporter

প্রকাশিত: ১:৩০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০২৫

দেশের একমাত্র ঔষধি পল্লী এখন নাটোরের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এই পল্লীতে প্রতিনিয়ত দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনাগোনা ঘটে, যারা ভেষজ প্রকল্পের সৌন্দর্য ও কার্যকারিতা দেখে মুগ্ধ ফিরে যান। বছরে শুধুমাত্র অ্যালোভেরা উৎপাদিত হয় প্রায় ১৫ হাজার টন, সঙ্গে অন্যান্য ভেষজ like শিমুল মূল, অশ্বগন্ধা, বিটরুট, রোজেলা ও শতমূলের উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য। এসব ভেষজের বাজার মূল্য অন্তত শত কোটি টাকার কাছাকাছি বলে ধারণা করা হয়।

নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নে এই ভেষজ পল্লী অবস্থিত, যা আদর্শ পরিবেশে, ইউনিয়নের প্রধান সড়কের কাছাকাছি সুন্দর এক এলাকায়। ১৯৯৫ সালে খোলাবাড়িয়া এলাকার কবিরাজ আফাজ পাগলা স্বউদ্যোগে ভেষজ উদ্ভিদের চাষ শুরু করেন। মূলত এই উদ্যোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, গ্রাম ও ইউনিয়নের সব কোথায় কোথায় চোখে পড়ে নানা ধরনের ভেষজ গাছের সমাহার। অ্যালোভেরা সর্বাধিক দৃষ্টিনন্দন ও জনপ্রিয়।

জেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এ এলাকায় বর্তমানে ১৪০টিরও বেশি ভেষজ উদ্ভিদ জন্মে। এর মধ্যে অ্যালোভেরা ছাড়াও শিমুল মূল, অশ্বগন্ধা, ভিটরুট, মিশ্রী দানা, রোজেলা ও শতমূলের উপযোজীতা চোখে পড়ার মতো। মোট আবাদি জমির ৭০ হেক্টরে অ্যালোভেরা চাষ হচ্ছে, যেখানে এক বছর চার মাসের মধ্যেই পাতার সংগ্রহ শুরু হয়।

অ্যালোভেরার উৎপাদন থেকে প্রতি বছর প্রায় ১,২০০ টন পাতার বাজারমূল্য হয় কোটি টাকারও বেশি। এর পাশাপাশি শিমুল মূল থেকে বছরে প্রায় ৫০ টন, বিটরুট ও মিশ্রী দানা থেকে যথাক্রমে ৫০ টন করে ও অশ্বগন্ধা থেকে ১২ টন উৎপাদিত হয়। এইসব ভেষজ কৃষিতে জড়িত আছেন প্রায় দুই হাজার কৃষক।

নবান্নের পরে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে প্রত্যেক বিঘা জমিতে ১০ হাজার চারা রোপণের মাধ্যমে অ্যালোভেরা চাষ হয়। এই চাষে সেচ এবং যত্ন নেওয়া হয় পুরো বছরজুড়ে। চাষীদের জন্য জৈব সার, ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা ও বোরিক এসিডের ব্যবহারে গুরুত্ব রয়েছে, পাশাপাশি পাতার গুণমান বজায় রাখতে অ্যালোভেরার পাতায় কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বর্তমানে অ্যালোভেরার গড় উৎপাদন প্রতিবিঘা প্রায় ৩০ টন। শুকনো ভেষজ পতিতা প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ভেষজ ওষুধ। এই ভেষজ ওষুধের বিপণন চলমান এলাকার চারটি কেন্দ্রে, যেখানে প্রায় শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিযুক্ত।

নাটোরের ভেষজ চাষের সঙ্গে জড়িত কৃষক, সমবায় নেতা ও কবিরাজ মো. জয়নাল আবেদিন জানাচ্ছেন, যদি অ্যালোভেরার সংরক্ষণে হিমাগার নির্মাণ, প্রসাধনী তৈরির কারখানা ও অন্যান্য আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোला হয়, তবে তারা আরও বেশি লাভবান হতে পারবেন।

একই সময়ে খোলাবাড়িয়া হাজীগঞ্জ বাজারের ভেষজ উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম দাবি করেছেন, এলাকায় একটি ঔষধি উদ্ভিদ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন প্রয়োজন—যা পণ্যের গুণাগুণ ও মান নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। এর ফলে ভেষজ পণ্য আরও দক্ষতার সঙ্গে বাজারে ছড়িয়ে পড়বে, এবং নতুন ব্যবসার অবতারণা হবে।

নাটোর সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা নীলিমা জাহান বলেন, বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ভেষজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন বা কৃষি শ্রমের কাজে জড়িত। এই পল্লীর বিস্তার ক্রমশ বাড়ছে, যা স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অপরদিকে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নাটোর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. হাবিবুল ইসলাম খান বলেন, যদি অপারেশনাল হিমাগার, প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও গবেষণা সুবিধা প্রতিষ্ঠা হয়, তাহলে এখানকার কৃষকরা লাভবান হবেন এবং এই ঔষধি পল্লী আরও সমৃদ্ধ হবে। এই উন্নয়ন শুধু এলাকায় নয়, সমগ্র দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক উপযুক্ত চিকিৎসা ও আয়ের উৎস হয়ে উঠতে পারে।