গাজায় শিশুদের শ্রবণশক্তি হারানোর ভয়ংকর ছবি

Staff Staff

Reporter

প্রকাশিত: ৩:৪৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৫, ২০২৫

গাজার আল-ওয়াফা মেডিকেল পুনর্বাসন হাসপাতালে দুই ফিলিস্তিনি ছেলে একে-অপরের পাশে শুয়ে আছে। তারা দুই ভাই। একজন আট বছর বয়সী ইসমাইল আবু আল-জিবিন ইলিয়াস এবং অপরজন পাঁচ বছর বয়সী আবু আল-জিবিন। তাদের মা আয়া আবু আউদা নিজেদের সাথে মৃদুস্বরে কথা বলছিলেন, তবে শিশুরা কোনো সাড়া দিচ্ছিল না। গাজা শহরের তেল আল-হাওয়া এলাকার তাদের বাস্তুচ্যুত শিবিরে ইসরায়েলি বোমা হামলার সময় এই দুই ভাই আহত হয়। এখন তারা বধির হয়ে গেছে, কানে শুনতেও পারে না। গাজার দশজনের মধ্যে চারজন এই শারীরিক ক্ষতিগ্রস্ত।

আতফালুনা সোসাইটি ফর ডেফ চিলড্রেন দ্বারা পরিচালিত একটি মাঠ জরিপে দেখা গেছে, ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের যুদ্ধের কারণে এফ-১৬ বিমান ও বিস্ফোরণের শব্দে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু সহ প্রাপ্তবয়স্করা আংশিক বা পুরোপুরি শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন।

মিডলইস্ট আইয়ের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ওই হামলার ফলে ইলিয়াস সম্পূর্ণ বধির হয়ে যায় এবং ইসমাইলের শ্রবণশক্তি অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেখানে আয়া তার সন্তানদের জন্য অস্থায়ী তাঁবুতে ঘুমাচ্ছিলেন, সেখানে পড়ে আছে আহত ইসমাইল। তার দুই চোখ ও এক হাত ক্ষতিগ্রস্ত। পুরোপুরি শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু সপ্তাহ পরে তার মা লক্ষ্য করেন, কথা বললেও ছেলে আর সাড়া দেয় না, সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।

ব্রেইনস্টেম অডিটরি পরীক্ষায় দেখা যায়, তার ডান কানের শ্রবণশক্তি ৫০ শতাংশ এবং বাঁ কানের ৭১ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত। ইলিয়াসের অবস্থা আরও গুরুতর। সে ১৮ দিন কোমায় ছিল। যখন জেগে ওঠে, তখন থেকে তার কোনও শ্রবণশক্তি নেই। গাজার বহু পরিবারই এই ধরনের অসুস্থতা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অডিওলজি বিশেষজ্ঞ ইউসরা বাসিল নিশ্চিত করে বলেন, ইফ-১৬ যুদ্ধবিমান ও বোমার শব্দের কারণে বাসিন্দাদের শ্রবণশক্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গত দুই বছরে গাজায় প্রতিটি ১০ জনের মধ্যে চারজন এই সমস্যায় ভোগছেন।

আলজাজিরা জানায়, গাজা সরকারি মিডিয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ৪৪ দিনে প্রায় ৫০০ বার ইসরায়েলি শক্তি গাজায় আঘাত হেনেছে। এসব হামলায় অন্তত ৩৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই শিশু, নারী এবং বৃদ্ধ। এক বিবৃতিতে জানানো হয়, এই কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। সর্বশেষ শনিবার ২৭ বার হামলা চালানো হয়েছে, এতে ২৪ জন শহীদ এবং ৮৭ জন আহত হয়েছেন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েল বিধ্বস্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, তারা হামাস ও হিজবুল্লাহর ওপর হামলা চালিয়ে যাবে, কারণ তারা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে।

গাজায় প্রতিদিন গড়ে দুই শিশু নিহত: ইউনিসেফ

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও গাজায় প্রতিদিন গড়ে দুই শিশু মারা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। সংস্থাটি বলছে, হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য যে চুক্তি হয়েছিল, সেটি কার্যকর থাকা সত্ত্বেও সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। জেনেভায় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় ইউনিসেফের মুখপাত্র রিকার্দো পাইরেস বলেছেন, ‘১১ অক্টোবর থেকে যুদ্ধবিরতি চালু থাকলেও গাজা উপত্যকায় অন্তত ৬৭ শিশু নিহত হয়েছে এবং আরও অনেক আহত।’

তিনি আরও বলেন, এই সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়। সম্ভবত শিশুদের জীবনের জন্য সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা—সেখানে তারা অঙ্গহানি, খোলা আকাশের নিচে ঘুমাচ্ছে, অনেকে এতিম এবং ভয়ের বলয়ে রয়েছে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টে যখন আমি সেখানে ছিলাম, তখন দেখেছি জলমগ্ন অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে শিশুরা কাঁপছে। তাদের জন্য নিরাপদ স্থান নেই, তবে বিশ্বের ব্যর্থতা এড়ানো যায়নি। ইউনিসেফ এখন গাজায় তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে, তবুও বাস্তবে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তারা।

আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন: পাকিস্তানের নিন্দা

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই হামলা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট অমান্য, জাতিসংঘের প্রস্তাবনা ও শান্তি চুক্তির লঙ্ঘন। পাকিস্তান গাজার ওপর ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটি আন্তর্জাতিক সমাজের জন্য উদ্বেগজনক।

হামাসের মধ্যস্থতায় কায়রো অভিযাত্রা

গাজা যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারীদের সাথে বসবার জন্য হামাসের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি কায়রোতে অবস্থান করছে। মিসরীয় সূত্র জানিয়েছে, এই প্রতিনিধিদলটি ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের বিষয়ে আলোচনা করবে। মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার মধ্যে তারা আলোচনা চালাচ্ছে। হামাসের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে রয়েছেন খলিল আল-হাইয়ার।

মিসরের গোয়েন্দা প্রধানের সাথে বৈঠক

হামাসের এক শীর্ষ নেতা কায়রোতে মিসরের গোয়েন্দা প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের বিষয়ে আলোচনা করে। তাদের ভাষ্য, গাজায় ইসরায়েলের ক্রমাগত হামলা আবারও যুদ্ধের অবসান দূর করে দিচ্ছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা প্রথম ধাপে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে মিসরের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।

নতুন তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল কয়েক সপ্তাহে প্রায় ৫০০ বার গাজায় হামলা চালিয়েছে, এতে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত ও বহু আহত হয়েছেন। এসব ঘটনার প্রভাব, ক্ষতিপূরণ ও পরবর্তী পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে আলোচনা চলমান থাকবে।