নরসিংদীর তিন উপজেলায় বিলাতি ধনিয়ার ব্যাপক চাষ, অর্থনৈতিক বদল ঘটাচ্ছে

Staff Staff

Reporter

প্রকাশিত: ৩:৪০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৭, ২০২৫

নরসিংদীর তিন উপজেলার কৃষকদের কাছে বিলাতি ধনিয়া পাতা আজ দ্বিতীয় আরেকটি স্বর্ণাকর হয়ে উঠেছে। উদ্যোগী কৃষকেরা কম বিনিয়োগে বেশি লাভ পেয়ে আনন্দের সাথে এই পাতা চাষে ঝুঁকছেন। এক সময় এ পাতার চাহিদা ছিল খুবই সীমিত, তবে বর্তমানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এর ব্যাপক চাহিদা দেখা যাচ্ছে। এটি আকারে বড়, স্বাদে ঝাঁঝালো এবং গন্ধে অনন্য হওয়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে সাধারণ ঘরোয়া রান্নায় এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে করে এই তিন উপজেলার কৃষিজীবীদের অর্থনৈতিক কক্ষপথ পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে।

শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের কৃষক জজ মিয়া (৬০) প্রায় ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন সবজি ও মসলা জাতীয় ফসলের চাষ করে আসছেন। সম্প্রতি তিনি ১০ শতক জমিতে বিলাতি ধনিয়া পাতা চাষ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে তার জমিতে উৎপাদিত পাতাগুলো থেকে ৭২ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। আরও ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার পাতা বিক্রির আশা করছেন। ধনিয়া চাষে এই বছর তার খরচ হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার টাকা। তিনি বলেন, “প্রথমে এই পাতার চাহিদা খুব একটা ছিল না, তবে এখন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর কদর বেড়েছে। খরচ কম, যত্ন কম, অথচ লাভ অনেক বেশি।”

অন্য এক কৃষক জুলেখা বেগম (৫০) বলেন, “৮ শতক জমিতে ১২ হাজার টাকা খরচ করে আমি বিলাতি ধনিয়া চাষ করেছি। এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার টাকার পাতা বিক্রি করেছি। আরও ১০-১২ হাজার টাকার পাতা বিক্রি হবে বলে আশা করি। এই চাষে সার, পানি ও শ্রমের খরচ কম, তাই লাভ বেশি।”

স্থানীয় বাজারে প্রচুর পাইকারী ক্রেতা আসছেন, বলে জানালেন সবজি বিক্রেতারা। প্রতি কেজি বিলাতি ধনিয়া পাতার মূল্য রয়েছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকার মধ্যে। এই পাতার বাজার ফেটে উঠেছে বটেশ্বরের ধনিয়া বাজারে, যেখানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা আসছেন কিনতে।

কৃষকেরা মনে করেন, সরকার যদি বাজার ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ সুবিধা আরও উন্নত করে, তবে এটি রপ্তানি পণ্যের দিকে এগোতে পারে। বিশেষ করে শীতকালে এর উৎপাদন বেশি হয়, তাই সংরক্ষণের জন্য যদি আধুনিক সুবিধা দেওয়া যায়, তবে কৃষকদের যেমন লাভ হবে, তেমনি দেশের বৈদেশিক আয়ও বাড়বে।

জেলার কৃষি বিভাগ জানায়, এ বছর নরসিংদীতে ৫৫ একর জমিতে বিলাতি ধনিয়া পাতা চাষ হয়েছে, আবাদ দিন দিন বাড়ছে। ফলন তুলনামূলক বড়, এর ঘ্রাণ তীব্র ও স্বাদ ঝাঁজালো হওয়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে ঘরোয়া রান্নায় এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় উৎপাদিত এই ধনিয়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে।

বাজারে ব্যাপক চাহিদার কারণে কৃষকেরাও এই ফসলের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছেন। সকাল থেকেই এই বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড় উপচে পড়ে। পাইকারি বিক্রেতা আব্দুল আলীম (৪৫) বলেন, “আমি এখানকার বটেশ্বর বাজার থেকে পাতাগুলোর কিনি। কেজি প্রতি ১৪০ থেকে ১৮০ টাকায় কিনে ঢাকায় পাঠাই। সমস্ত খরচ বাদে প্রতিটি কেজিতে ৮-১০ টাকার লাভ হয়। এই পাতাগুলোর গুণগত মান খুব ভালো।”

নরসিংদীর সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু কাউছার সুমন বলেন, “আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ধনিয়া পাতার ভিটামিনগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’ ও ‘কে’ থাকায় এটি ত্বক ভাল রাখে, পেটের বিভিন্ন সমস্যা কমায় ও রক্ত জমাট বাঁধতেও সহায়তা করে। বদহজম বা কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে ধনিয়া পাতার সরবত পান করাও উপকারী।”

প্রধান কৃষি কর্মকর্তা ও গবেষকরা বলেন, ধনিয়া পাতার চাষে মাটি বা আবহাওয়া কোনও বিশেষ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না। সহজে জৈব সার, অল্প সেচ ও পরিচর্যায় ভালো ফলন পাওয়া যায়। বেলাবো উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মহিবুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, “বিলাতি ধনিয়া পাতা বর্তমানে কৃষকদের জন্য রোজগার করার একটি লাভজনক উপায়। আমরা নিয়মিত পরামর্শ, বীজ সরবরাহ ও আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।”

তিনি আরও জানান, সঠিক পরিচর্যায় এক বিঘা জমিতে এই ধনিয়া চাষ করে তিন থেকে চার লাখ টাকার পাতা বিক্রি করা যায়, যে খরচও বেশ কম। তাই বেশিরভাগ কৃষকই এই ফসল থেকে দারুণ মুনাফা লাভ করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিলাতি ধনিয়া পাতার এই আবাদ নরসিংদীর কৃষি অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। সরকারি সহায়তা ও পরিকল্পনা অব্যাহত থাকলে, ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের ধনিয়া পাতার বিস্তার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও পৌঁছাতে সক্ষম হবে।